গল্প: টুং টাং কিং ꡶ Story: Tung Tang King

 

Story: Tung Tang King
Story: Tung Tang King

গল্প: টুং টাং কিং ꡶ Story: Tung Tang King

আসসালামু আলাইকুম

বিজ্ঞানের নতুন টিচার প্রথম ক্লাসটা এমনই মাতিয়ে গেলেন যে, শিক্ষার্থীরা ভীষণ উৎফুল। এমন টিচার তারা পায়নি আগে। তার বক্তব্য উপস্থাপনার চমৎকারিত্বে সবাই মুগ্ধ। কিন্তু তিনি নিজেকে যে কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফাঁকিবাজ বললেন তা শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে রইল এক বিস্ময় ও হেঁয়ালী। নিজের সম্পর্কে তিনি একটি কবিতা বলেন যার মাথামুন্ডু বোঝেনি কেউ। তিনি বলেন: 

আমি ফাঁকিবাজের চেলা

যদি করো অবহেলা

দেব এমন টাইট

দিনটা হবে নাইট

আমি ফাঁকিবাজের চেলা

শুকনো জলে ভাসিও না ভেলা

এমন পিছল খাবে

হাড্ডিগুলো যাবে

আমি ফাঁকিবাজের চেলা

করো না কেউ হেলা।

খালিদ স্যারের পান্ডিত্যে সবাই মুগ্ধ ও বিস্মিত। কিন্তু তিনি নিজেকে ফাঁকিবাজ বলে সগর্ব ঘোষণায় সবাই বিভ্রান্ত। প্রথম দিন তিনি যেসব ক্লাসে গেছেন সেসব ক্লাসেই একই প্রতিক্রিয়া। তাকে প্রশ্ন করে হারানো অসম্ভব। যে কোন কঠিন প্রশ্নের জবাবও যেন লেগে থাকে তার ঠোঁটেই। কয়েক দিনের মধ্যেই স্কুলের সবাই বুঝে গেল যে খালিদ স্যার আসলেই জিনিয়াস।

সাদিয়া, আঁখি, মল্লিকা, নাঈম ও নওরিন একদিন টিফিনের সময় বসে পরামর্শ করল যে, খালিদ স্যারকে বিব্রত করা যায় কিভাবে। টিচারকে বিপদে ফেলতে পারলেই ওদের আনন্দ। প্রথম ক’দিন ওরা বিভিন্ন বই খুঁজে খুঁজে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করল। কিন্তু না, খালিদ স্যারকে টলানো গেল না। তিনি এত সহজেই জবাব দেন যে, ওরা স্যারকে নতুন প্রশ্ন করার সাহস পায় না আর।কয়েকদিন ধরে স্কুলের ফাইভ স্টার খ্যাত শিক্ষার্থীরা করল অনেক গবেষণা। 

ওরা লেখাপড়ায় যেমন ভাল, তেমন দুষ্টুমিতেও। ভালো লেখাপড়ার কারণে কোন টিচার ওদেরকে শাস্তি দেন না, বরং উপভোগ করেন ওদের ছোটখাট দুষ্টুমিগুলো। খালিদ স্যারকে ঝামেলায় ফেলতে না পারলে যেন ওদের শান্তি নেই। দীর্ঘ গবেষণা করে নাঈম একটা যন্ত্র আবিষ্কার করল যা দেখে ফাইভ স্টার রীতিমত উত্তেজিত। কিভাবে যন্ত্রটি কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবছে ওরা। যন্ত্রটির নাম দিয়েছে টুং টাং কিং। সংক্ষেপে কিং। যন্ত্রটি মূলত একটি রিমোট কন্ট্রোলার। এর ভেতরে নাঈম যোগ করেছে আরো কিছু ফাংশন। এই ফাংশনগুলোই সবচে মজার। নাঈম প্রত্যেককে একটি করে কিং দিয়েছে যথা সময়ে কাজে লাগানোর জন্যে। 

সাদিয়াদের ক্লাসে গিয়ে খালিদ স্যার প্রথমেই খেলেন একটা হোঁচট। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে কেন তিনি দেখছেন এমন। প্রতিদিনই ছেলেরা বসে ডান পাশের বেঞ্চে আর মেয়েরা বামে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকেই স্যার দেখলেন ছেলে-মেয়েরা সাইড পরিবর্তন করেছে। তিনি ভাবলেন যে হয়ত ক্লাস টিচার আজই করেছেন এমন। কিন্তু পড়াতে গিয়ে তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তার নিজের কানকে। তিনি প্রশ্ন করলেন মেয়েদের একজনকে অথচ জবাব এল ছেলেদের দিক থেকে। আবার মেয়েদের একজনকে প্রশ্ন করলেন অথচ জবাব এল ছেলেদের দিক থেকে। তিনি দিব্যি চশমা দিয়ে দেখছেন। নিজেই তাকিয়ে আছেন ছেলেদের দিকে অথচ শব্দ শোনা যাচ্ছে মেয়েদের দিক থেকে আবার যখন তাকাচ্ছেন মেয়েদের দিকে তখন শব্দ আসছে ছেলেদের দিক থেকে। তিনি বুঝতে পারছেন না কেন হচ্ছে এমন। একবার ভাবলেন হয়ত বেশি রাত জাগার ফলে এমন হতে পারে। 

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আর তিনি আস্থা রাখতে পারলেন না নিজের কানের উপর। একটা সহজ প্রশ্নের জবাব যখন সবাই একসাথে পারি বলে উঠল তখন তিনি শুনলেন যে কন্ঠস্বর সম্পূর্ণ এল বিপরীত সাইড থেকে। তিনি খুলে ফেললেন নিজের চশমা। এবার যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের চোখকেও। চশমা খুলেই দেখলেন যে এতক্ষণ তিনি ভেবেছিলেন ভুল। ছেলেরা ছেলেদের সাইডে আর মেয়েরা বসে আছে মেয়েদের সাইডেই। কিন্তু এতক্ষণ তাহলে তিনি বিপরীত দিকে তাকিয়ে থেকেছিলেন কেন? রহস্য থেকে গেল রহস্যই। ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেলে তিনি চলে যেতেই চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন যে, সাদিয়া হাসল কেমন যেন রহস্যময়। 

এরপর আঁখিদের ক্লাসে ঢোকার আগেই তিনি চশমা খুলে দূর থেকেই দেখে নিলেন ক্লাসের পরিবেশ। না, চোখে পড়ল না কোন পরিবর্তন। কিন্তু ক্লাসে ঢুকতেই সবাই সালাম দিল অথচ কণ্ঠস্বর মনে হল সব আসছে বিপরীত দিক থেকে। খালিদ স্যার ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে খুলে ফেললেন চশমাটা। কিন্তু চশমা খুলতেই সব মনে হল স্বাভাবিক। পড়াতে পড়াতে প্রশ্নোত্তর পর্বে খালিদ স্যার আবার পড়লেন দ্বিধায়। আবার মনে হল, ছেলেদের কন্ঠস্বর মেয়েদের দিকে থেকে আর মেয়েদের কন্ঠস্বর ছেলেদের দিক থেকে আসছে। ব্যাপারটা আসলে কী তা তিনি বুঝতে পারছেন না কিছুতেই। গতরাতে বেশি জেগে পড়াশোনার জন্যে এমন হতে পারে বলে মনে হচ্ছিল তার কিন্তু আগেও তো এরচে বেশি রাত জেগেছেন, তখন তো হয়নি কোন সমস্যা। ঘটনা যা-ই হোক খালিদ স্যার পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়। এ রহস্য উদঘাটন করতেই হবে তাকে। এই ক্লাসটিও শেষ করে বেরুনোর সময় দেখলনে যে আঁখি বেশ উত্তেজিত। কেমন রহস্যময় হাসি লেগে আছে তার মুখে।

এরপর মল্লিকাদের ক্লাসে গিয়েও ঘটল একই ঘটনা। খালিদ স্যার স্থির সিদ্ধান্তে এলেন যে, এর পিছনে অবশ্যই আছে কোন রহস্য। টিফিন পিরিয়ডে তিনি ব্যাপারটি নিয়ে ভাবলেন গভীরভাবে। কিন্তু পারলেন না কোন সমাধানে পৌঁছাতে। টিফিনে ফাইড স্টার একসাথে বসে তাদের কিং এর কারসাজি নিয়ে করল আলোচনা। সাদিয়া, আঁখি আর মল্লিকার আভিজ্ঞতা শুনে নাঈম আর নওরিন ভেতরে ভেতরে হয়ে পড়ল ভীষণ উত্তেজিত। তাদের যেন আর সহ্য হচ্ছিল না দেরী। কখন পরের ক্লাস শুরু হবে তা ভাবতেই তারা উঠছিল শিউরে শিউরে।

নাঈমের ক্লাসে প্রবেশের আগে থেকেই খালিদ স্যার খুব সতর্কভাবেই শুরু করলেন তার পর্যবেক্ষণ। তিনি সব কিছু লক্ষ করছেন বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নাঈমের ক্লাসেও একই ঘটনা ঘটতে থাকলে খালিদ স্যার বারবার খুলতে লাগলেন তার চশমা। চশমা খুললেই সবকিছু লাগছিল স্বাভাবিক। চশমা চোখে দিতেই হচ্ছিল অস্বাভাবিক। চশমা চোখে দিতেই হচ্ছিল সব এলোমেলো। খালিদ স্যার প্রথমে ঘনঘন খুলছিলেন চশমা পরে বেশ কিছ্ক্ষুণ সময় নিয়ে চশমা খুলে আবার পরে করছিলেন তার গভীর পর্যবেক্ষণ। কিন্তু এখানেও আসতে পারলেন না কোন সিদ্ধান্তে। এ ক্লাস থেকেও বের হওয়ার সময় খালিদ স্যার কৌশলে দেখে নিলেন যে নাঈম বেশ উৎফুল্ল। সে মনে হল খুব উত্তেজিত কোন বিষয় নিয়ে। 

পরের ক্লাসেও ঘটল একই ঘটনা। নওরিন তার পাশের বান্ধবীর সাথে ফিসফিস করে বলছিল কী যেন। খালিদ স্যার তার কথা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে উল্টো প্রশ্ন করল, স্যার আপনি কি অসুস্থ ?

স্যার জবাব দিলেন, না।

তাহলে কি স্যার আপনি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তি? নওরিন আবার জানতে চাইল।

না তা ঠিক নয়। তবে আমি চেষ্টা করছি একটি রহস্য উদঘাটনের।

রহস্যটা কি স্যার আমাদের নিয়ে? নওরিন জানতে চাইল।

খালিদ স্যার নওরিনের এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে খুলে ফেললেন তার চশমা। তীক্ষèভাবে তিনি নজর রাখলেন নওরিনের কার্যকলাপের উপরে। তিনি পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বুঝতে পারলেন যে নওরিন মাঝে মাঝে হাত দিচ্ছে তার ব্যাগের ভেতর। খালিদ স্যার এ নিয়ে বললেন না কিছুই। এ ক্লাস থেকেও বের হওয়ার সময় তিনি বুঝতে পারলেন যে নওরিন খুব খুশি। সে যেন এভারেষ্ট জয় করেছে এমন একটা হাসি লেগে ছিল তার মুখে।

শেষ ক্লাসে খালিদ স্যার গেলেন অন্য একটি ক্লাসে। এখানে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। সবই স্বাভাবিক। মনের উপরে কোন চাপ অনুভব করলেন না। আবার খুব যে নির্ভার থাকলেন তাও নয়। তার মাথার মধ্যে একটি বিষয় শুধু ঘুরছে তা হল সেই রহস্য যা তাকে বাধ্য করছিল সব কিছু উল্টাপাল্টা ভাবতে।

পরের দিন আবারও খালিদ স্যার পড়লেন নতুন সমস্যায়। তিনি সাদিয়ার ক্লাসের গিয়ে ছেলেদের কারো নাম ধরে পড়া জিজ্ঞাসা করতেই বুঝতে পারলেন যে তার মুখ থেকে বের হচ্ছে কোন মেয়ের নাম। আবার কোন মেয়ের নাম ভাবতেই মুখ থেকে বের হচ্ছে কোন ছেলের নাম। পরপর একই ঘটনা ঘটল আঁখি, মল্লিকা, নাঈম ও নওরিনের ক্লাসেও। প্রত্যেক ক্লাস শেষেই ওদের মুখে সেই রহস্যময় হাসি। কিন্তু শেষের ক্লাসে আবার সবই স্বাভাবিক। খালিদ স্যার সিদ্ধান্তে এলেন যে ফাইড স্টারই নিশ্চয় এমন কিছু করছে যা এখনো তাঁর কাছে অজানা।

সেদিন সারারাত খালিদ স্যার সেই গুপ্ত রহস্য নিয়ে ভাবলেন কিন্তু ব্যাপারটা কী হতে পারে তা পারলেন না বুঝতে। তবে ফাইভ স্টারকে তিনি চোখে চোখে রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন মনে মনে। ফাইভ স্টারের ভেতরেই কোন রহস্য আছে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। পরদিনও ক্লাসে আবার ঘটল কিছু উল্টাপাল্টা ঘটনা। এদিন ভয়াবহ ব্যাপার ঘটায় খালিদ স্যার ভয় পেয়েই গেলেন কিছুটা। তিনি লক্ষ করলেন যে, তিনি ডান হাত দিয়ে কোন কাজ করতে চাইলে বাম হাত দিয়ে করছেন আবার বাম হাত দিয়ে করতে চাইলে করছেন ডান হাত দিয়ে। ব্যাপারটা প্রকট হয়ে দেখা দিল তার বোর্ডে লেখার সময়।

তিনি বোর্ডে বাম হাত দিয়ে খুব বাজেভাবে লিখছেন দেখে ছেলে-মেয়েরা সবাই হেসে ওঠে এক সাথে। খালিদ স্যার বাম হাত দিয়ে লিখবেন বলে ভাবতেই দেখলেন তিনি আবার লিখছেন ডান হাত দিয়ে। ক্লাসের ভেতর হাঁটার সময় তিনি প্রায়ই অস্বস্তি বোধ করছিলেন ভীষণ। ডান পা দিয়ে হাঁটা শুরুর কথা ভাবতেই দেখছিলেন আগে যাচ্ছে বাম পা। আবার বাম পা দিয়ে হাঁটতে চাইলেই আগে যাচ্ছিল ডান পা। এভাবে অস্বস্তি নিয়ে সাদিয়ার ক্লাস শেষে গেলেন আঁখিদের ক্লাসে। সেখানে গিয়ে পড়লেন বেকায়দা সমস্যায়। বসতে চাইলে যাচ্ছিলেন দাঁড়িয়ে, দাঁড়াতে চাইলেই পড়ছিলেন বসে। এভাবে কি পড়ানো যায় ? তারপরও বেশ ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেন। স্যারের বেগতিক অবস্থা দেখে আঁখি হাসছিল মিটমিট করে। খালিদ স্যারের চোখ এড়ায়নি তা। এরপর স্যার গেলেন মল্লিকাদের ক্লাসে। 

এখানে যে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে তিনি তা টের পাননি ঘুণাক্ষরেও। তিনি বোর্ডে যা লিখছিলেন তার সবই হচ্ছিল উল্টো। ছেলে-মেয়েরা প্রথমে কেউ বোঝেনি একমাত্র মল্লিকা ছাড়া। অন্যরা ভাবছিল যে স্যার এ লেখা থেকে বুঝাবেন হয়ত নতুন কিছু। কিন্তু স্যার যখন শিক্ষার্থীদের দিকে ফিরে বলা শুরু করলেন তখন সবাই হেসে উঠল হো হো করে। স্যারের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে মল্লিকা মনে মনে কিছুটা কষ্ট পেলেও নিজেদের আবিষ্কার কিং এর সাফল্যে হল উজ্জীবিত। খালিদ স্যার যতই বুঝাচ্ছেন যে তোমরা বোর্ডে লক্ষ কর এ বিষয়টি লেখা আছে শিক্ষার্থীরা ততই শুরু করল হাসাহাসি। খালিদ স্যার ব্যাপারটি না বুঝেই তাকালেন বোর্ডের দিকে। দেখলেন সবই ঠিক আছে। কিন্তু যেই না তিনি চশমা খুলে তাকিয়েছেন তার চক্ষু চড়কগাছ। হায় হায় সবই যে লিখেছেন উল্টো। এবার তিনি চশমা খুলেই বোর্ডে লিখলেন নতুন করে। ব্যাপারটি কেন, কী ঘটেছিল সে বিষয়ে তিনি বললেন না কিছুই। হ্যাঁচ্চো নামের মজার একটা গল্প দিয়ে তিনি সবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিলেন অন্য দিকে। গল্পটি এতই মজার যে, সবাই ভুলে গেল স্যারের উল্টো লেখার কথা।

খালিদ স্যার এলেন নাঈমদের ক্লাসে। এখানেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা অনুমান করেছিলেন তিনি। তাই চশমা খুলেই তিনি লেখা শুরু করলেন। লেখার সময় বোর্ডের দিকেও দিলেন মনোযোগ। প্রথম লাইন লেখার পরই সমস্যা দেখা দিল চোখে। সবকিছু ঠিক আছে জেনেই চশমা চোখে দিয়ে শুরু করলেন লেখা। প্রথমে ছেলে-মেয়েরা বুঝতে পারেনি। কয়েক লাইন লেখার পর স্যারের পেছনে ওঠে গুঞ্জন। স্যার পেছনে তাকাতেই একজন বলে উঠল, স্যার, ইংরেজিতে কী লিখছেন বুঝতে পারছি না কিছুই। স্যার চশমা খুলতেই টের পেলেন কী ঘটেছে। তিনি আবার চশমা পরতেই দেখলেন সব ঠিক আছে। কিন্তু চশমা খুললেই টের পাচ্ছেন সব উল্টো। বোর্ড মুছে তিনি আবারও লিখলেন বেশ সতর্কতার সাথে আর খেয়াল রাখলেন নাঈমের দিকে। সে মাঝে মাঝে হাত দিচ্ছিল তার ব্যাগে। স্যার কিছুই বললেন না ব্যাপারটি নিয়ে। ক্লাস শেষে নাঈমকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলেন যে উল্টো লেখা হওয়ার পেছনে হাত আছে তার। 

খালিদ স্যার নওরিনের ক্লাসে ঢুকলেন সব ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করে। ফাইভ স্টারের সবচে ছোট সদস্য নওরিন। খালিদ স্যার শুরু থেকেই মনোযোগ দিলেন তার দিকে। তিনি বোর্ডে লেখা শুরু করলেন খুব কৌশলে। কোনভাবেই যেন লেখা উল্টো হয়ে না যায় তার দিকে তিনি থাকলেন বিশেষ যতœবান। একবার চশমা খুলছেন একবার পরছেন, কাজগুলো তিনি খুব দ্রæত করছেন। স্যারের লেখার সময় তিনি সবাইকে পড়তে দিয়েছেন আগের দিনের পড়া। স্যারের কাজটা তাই সহজ হয়ে যায়। ক্লাসের কেউই বোর্ডের দিকে খেয়াল করেনি। নওরিন কেবল মিটমিট করে হাসছিল আর তাকাচ্ছিল বোর্ডের দিকে। 

কিন্তু খালিদ স্যার লেখা শেষে যখন ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে পড়া নেয়া শুরু করলেন তখনই পেছন থেকে একজন ছাত্র বলে উঠল, স্যার বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে বাংরেজি ভাষায় কী লিখেছেন তার কিছুই বুঝতে পারছি না। খালিদ স্যার বোর্ডে তাকাতেই চমকে উঠলেন। সত্যিই তো। এসব তিনি কী লিখেছেন? তিনি তার সমস্যার কথা অকপটে স্বীকার করলেন। বললেন, আসলেই কী লিখেছি তা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। দুঃখিত। তবে গত কয়েকদিন ধরে স্কুলে এলেই আমার বেশ কিছু ব্যাপার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত তোমাদের আর উপরের আরো চারটি ক্লাসে একই ঘটনা ঘটছে। 

আমি নিশ্চিত এখানে এমন কোন ঘটনা ঘটছে যা আমার অজানা। স্যারের ঘটনা শুনে নওরিন জিজ্ঞাসা করল, স্যার, তবে কি ভূতে সব উল্টা-পাল্টা করছে? স্যার বললেন, না আমি ভূত বিশ্বাস করিনা। মানুষই কিছু করছে যা আমার আনুমানিক বিশ্বাস। আমি আশাবাদী যে কিছুদিনের মধ্যেই রহস্যটা উদঘাটন করতে পারব। এরপর ঘন্টা বাজতেই স্যার নওরিনকে সাথে নিয়ে টিচার্স লাউঞ্জে গেলেন। তিনি নিজের ক্লাসে অন্য একজন টিচারকে পাঠিয়ে নওরিনকে বসতে বললেন। স্কুলের পিওনকে পাঠিয়ে একে একে সাদিয়া, আঁখি, মল্লিকা ও নাঈমকে ডাকিয়ে আনালেন। সবাই স্যারের কথা মত স্কুল ব্যাগ সাথেই এনেছে। খালিদ স্যার শুরু করলেন কথা। 

তোমাদের পাঁচজনের ব্যাগে এমন কিছু আছে যা লেখা পড়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, বের কর। স্যারের কথা শুনে ফাইভ স্টারের সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। ওদের তাকানো দেখেই স্যার নিশ্চিত হলেন যে ওদের কাছে কিছু আছে। স্যার বললেন, বের করো যা আছে। তবে তোমাদের অভয় দিচ্ছি যে, এ ব্যাপারে তোমাদের কোন শাস্তি হবে না। স্যারের অভয় শুনে নওরিন তার রিমোটের মত জিনিসটা বের করে ফেলল। খালিদ স্যারের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিনিসটা বের করে ফেলল অন্য সবাই। স্যার কিছুই বুঝলেন না। নাঈম ব্যাখ্যা করল, এর নাম টুং টাং কিং। এটি দিয়ে তারা আলোর প্রতিফলন, শব্দ-তরঙ্গ ও শব্দের প্রতিধ্বনিকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছা মত যে কোন জিনিস উল্টো করে দিতে পারে। 

নাঈমের এই আবিষ্কারের কথা শুনে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন খালিদ স্যার। ফাইভ স্টার ভেবেছিল যে স্যার হয়ত রেগে যাবেন তাদের দুষ্টুমির জন্যে। তারা কয়েকদিন ধরে স্যারকে যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছে তার ফলে যে কোন মানুষের পক্ষে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিন্তু কী আশ্চর্য! স্যার তো রাগলেন না বরং তিনি পরে যা বললেন তা শুনে ফাইভ স্টারের চোখে পানি এসে গেল আনন্দে। স্যার বললেন, তোমাদের এই আবিষ্কারে আমি অত্যন্ত আপ্লুত। পৃথিবীর বহু সমস্যার সমাধান করা যাবে এই টুং টাং কিং দিয়ে। যেমন মনে করো, কেউ কোন খারাপ কাজ করলে আমরা দূর থেকে তার কাজ উল্টো করে দিয়ে ভাল কাজ করতে বাধ্য করব। এভাবে প্রত্যেক মানুষকে দিয়েই আমরা ভাল কাজ করাব। পৃথিবীতে থাকবে না কোন খারাপ কাজ। কেউ মিথ্যে বলতে চাইলেও আমরা তাকে বাধ্য করব সত্য বলতে। আগামী বিজ্ঞান মেলায় তোমাদের অংশগ্রহণের সব ব্যবস্থা করব আমি নিজেই।

খালিদ স্যারের কথা শুনে সবাই হাততালি দিল। সে বছরই বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়ে টুং টাং কিং পেল জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। সারা দেশের মধ্যে প্রথম হওয়ায় দেশে তো বটেই বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ল এর নাম। সারা পৃথিবী থেকে আসতে লাগল প্রশংসার বন্যা।

পরিশেষে বলতে চাই, উপরোক্ত গল্পটির মাধ্যমে অনেক শিক্ষামূলক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি না একটি মজার ঘটনা থাকে। তেমন একটি শিক্ষামূলক ঘটনাটি গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। মজার এই গল্পটির মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যে মজার সম্পর্ক তা তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের আরও মজার মজার লেখা নিয়ে আবার আসবো এ আশা ব্যক্ত করে আজকে শেষ করছি। 


সংগ্রহে: আনাসটেক বাংলা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url